সাপের ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ, ঈশ্বরদীতে ২ বছরে ১৫ মৃত্যু
ঈশ্বরদী, পাবনামেইল টোয়েন্টিফোর ডটকম-
নারী ও প্রসুতি চিকিৎসায় বিশেষ ভূমিকা রাখায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ১২ বার পুরস্কার ও পদকপ্রাপ্ত ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে সরকারিভাবে এই হাসপাতালে সাপের কামড়ের ভ্যাকসিন (অ্যান্টি স্নেক ভেনম) সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। আর তাই বিগত দুই বছরেই সাপের কামড়ে সঠিক সময়ে ভ্যাকসিন দিতে না পারায় মারা গেছে ১৫ জন। সাপের কামড়ে শিকার হওয়া রোগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসলেই চিকিৎসকরা পাঠিয়ে দিচ্ছেন পাবনা অথবা রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এখন বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপের ভয়ে চরের মাঠে যেতে পারছে না কৃষক।
এদিকে পদ্মানদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় ডুবে গেছে নদীর পাশের ঝোঁপঝাড়। যার ফলে ডাঙ্গায় ও চরের শুকনো উঁচু জায়গায় উঠে এসেছে নানা জাতের বিষধর সাপ ও প্রাণী। জনবসতি এলাকায় বেড়েছে এসব সাপের উপদ্রব। সাপ আতংকে এখন ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়া, লক্ষ্মীকুন্ডা, দাশুড়িয়া ও মুলাডুলি ইউনিনের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা। সাপের কামড় থেকে রক্ষা করতে পাবনা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল জনসচেতনা বৃদ্ধি করতে মাঠে কাজ করছেন। তারা ঘুরে গেছেন ঈশ্বরদীর সাঁড়া ইউনিয়নের মাঝদিয়াগ্রামসহ বিভিন্ন চরাঞ্চল। পাবনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়, ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয়দের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুধবার (১০ জুন) রাত সাড়ে ১২ টার দিকে ঈশ্বরদীর সাঁড়া ইউনিয়নের মাদরাসা পাড়া মুর্শেদ আলমের ছেলে মাজদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্র হুসাইন (১৩) নিজ ঘরে খাটের উপর শুয়ে থাকাবস্থায় বিষাক্ত গোকরা সাপ কামড় দেয়। তাকে ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়। কিন্তু সাপে কামড়ের ভ্যাকসিন (আ্যন্টি স্নেক ভেনম) না থাকায় তাকে পাবনায় প্রেরণ করেন চিকিৎসক। কিন্তু পাবনায় নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যায় হুসাইন।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কম্পানির ঈশ্বরদী অঞ্চলের পরিবেশক ড্যাফোডিলসের সহকারী বিক্রয় প্রতিনিধি মো. রাজা আলী (২০) গত বছরের ৬ আগস্ট ডিউটি শেষ করে রাতে বাড়ি ফেরার পথে সাপে কামড় দেয়। আত্মীয় স্বজনেরা তাকে রাত নয়টার দিকে ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। কিন্তু আ্যন্টি স্নেক ভেনম ভ্যাকসিন না থাকায় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ভর্তি না করে দ্রুত পাবনা কিংবা রাজশাহী যেতে বলেন। রাজশাহী মেডিক্যালে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। গত বছরের ২৪ জুলাই বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ফটকের পাশে বসত বাড়িতে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় শাহাজালাল (৫) নামের এক শিশুকে সাপে কামড় দেয়। বাবা-মা তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। তাকে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ওই হাসপাতালে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরই শিশুটি মারা যায়।
উপজেলার লক্ষ্মীকুন্ডা গ্রামের ইয়ারুল চরে কাজ করতে যাওয়ার পথে সাপে কামড় দেয়। তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়। কিন্তু ভ্যাকসিন না থাকায় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে পাবনা কিংবা রাজশাহীতে যেতে বলা হয়। রাজশাহীতে যাওয়ার পথে ইয়ারুলের মৃত্যু হয়। চলতি বছরের ৩০ মে সাঁড়া ইউনিয়নের মাঝদিয়ার বড়পাড়ায় সেলিনা খাতুন নামের এক গৃহবধুকে সাপে কামড় দেয়। তাকেও ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়। কিন্তু তাকে পাবনা মেডিক্যালে প্রেরণ করা হয়। সাহাপুর মালিথাপাড়ার সাপুড়ে সাহাবুল সাপের কামড়ে শিকার হলে তাকেও ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহীতে প্রেরণ করা হয়।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, ৫০ শয্যার এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ অবদান রাখায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পরপর ১২টি জাতীয় পুরস্কার ও পদক পায়। দূর-দূরান্ত থেকে এই হাসপাতালে মানুষ চিকিৎসা নিতে আসে। কিন্তু এখানে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালটিতে ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকেও এই ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। ফলে সাপে কামড়ের রোগীদের চিকিৎসার জন্য পাবনা কিংবা রাজশাহী যেতে হয়। ঈশ্বরদী থেকে সড়কপথে রাজশাহীর দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার, আর পাবনা শহরের দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার। পথে যেতে অনেক সময় যানজটের কবলে পড়তে হয়। ফলে বেশিভাগ রোগীই পথের মধ্যে মারা যায়।
উপজেলার মাঝদিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা মাদরাসার শিক্ষক ও সাংবাদিক মোহাম্মাদ শহিদুল্লাহ খান বলেন, বিরল ও নানা প্রজাতের বিষধর সাপ রাসেল ভাইপার, গোকরা, কেউটে সাপের উপদ্রব বেড়ে গেছে। পদ্মানদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় নদীর কুলের চর ও ঝোঁপঝাড়গুলো পানিতে ডুবে গেছে। এই কারণে সাপগুলো ডাঙ্গায় উঠে এসেছে। জনবসতি এলাকায় এদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, বিগত দুই বছরের মধ্যে এই এলাকায় বেশ কয়েকজনের সাপের কামড়ে প্রাণ হানির ঘটনা ঘটেছে।
লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের ৪ ওয়ার্ড মেম্বার জিয়াউল ইসলাম জিয়া ও স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক মিরাজ বলেন, পদ্মানদীতে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকাগুলোতে বিভিন্ন প্রজাতের বিষধর সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। এই সময় চরে কৃষকরা কাজে গিয়ে সাপের তাড়ায় শিকার হয়। অনেককেই কামড়ে মৃত্যুবরণ করেছে।
ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার এফ এ আসমা খান বলেন, দীর্ঘদিন থেকে সরকারিভাবে হাসপাতালে সাপে কামড়ের রোগীর চিকিৎসার জন্য ভ্যাকসিন সরবরাহ নেই। প্রয়োজনের সময় পাবনা থেকে আনতে হয়। এক ফাইল ভ্যাকসিনের দাম এক হাজার টাকা। একজন রোগীকে ১০ ফাইল ভ্যাকসিন দিতে হয়। এই জন্য খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। এই অবস্থায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য পাবনা থেকে ভ্যাকসিন আনতে অনেক সময় লাগে। ততক্ষণ পর্যন্ত রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তাই সাপে কাটা রোগীকে না রেখে দ্রুত পাবনা কিংবা রাজশাহী যেতে বলা হয়।
তিনি আরো বলেন, সাপে কামড়ের রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, (এ্যানেসথিয়া) অজ্ঞানের ডাক্তারকে সার্বক্ষণিক থাকতে হয়। কারণ ভ্যাকসিন চলাকালে সাপে কাটা রোগীর বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। এই হাসপাতালে এসব ডাক্তার নেই। তাই ভ্যাকসিনও মজুদ করে রাখা হয় না। ৫০ শর্য্যার এই হাসপাতালে অনেক পোস্ট ফাঁকা রয়েছে। বারবার ডাক্তারের দাহিদা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বরিহরাগতদের খারাপ আচরণের কারণে ঈশ্বরদীতে ডাক্তাররা আসতে চান না।
সাপের কামড়ের রোগীদের চিকিৎসার জন্য আ্যান্টি স্নেক ভেনম ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ ও হাসপাতালে ডাক্তারদের শুন্যতা কারণে জানতে পাবনা সিভিল সার্জন ডাক্তার মেহেদী ইকবালের মুঠোফোনে কল দিয়ে ও পরিচয় দিয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাননি।
কোন মন্তব্য নেই